রক্তজবা (The Red Hibiscus)

এক ভুতুড়ে জমিদার বাড়ি, রক্তজবার অভিশাপ, আর রক্তির প্রতিশোধের ভয়ংকর গল্প "রক্তজবা"। বাংলার লোমহর্ষক লোককথার আবহে রচিত এই গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে রহস্য আর ভয়ের অন্য এক জগতে।

রক্তজবা (The Red Hibiscus)

রাত তখন বারোটা প্রায়। মেঘলা আকাশে চাঁদ যেন লুকোচুরি খেলছে। কখনও কখনও আলোর ফোঁটা ছড়িয়ে সে উঁকি মারছে, আবার কখনো কালো মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে। "ঝম ঝম" করে বৃষ্টি নামছে।

মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমক যেন পুরো আকাশ-বাতাসকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কুমিল্লার সেই প্রাচীন জমিদার বাড়িতে আজকে মেজো ছেলের বিয়ে। বাড়িটা সাজানো হয়েছে যেন রাজপ্রাসাদ। চারদিকে আলোর ঝলকানি। অতিথিরা খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, গান-বাজনায় মশগুল। কিন্তু কেউ জানে না এই বাড়ির পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর রহস্য।

এই জমিদার বাড়ির পেছনে আছে একটা প্রাচীন কুয়া। সেই কুয়াকে ঘিরে আছে অনেক গল্প। শোনা যায়, সেই কুয়ায় নাকি জমিদারের এক অসুন্দর কিন্তু দয়ালু মেয়েকে জীবন্ত পুঁতে রাখা হয়েছিল। মেয়েটির নাম ছিল রক্তি।

কারণ, তার গায়ের রঙ ছিল একটু লালচে। তার সৎমা ছিলেন অসম্ভব রূপসী কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের অধিকারিণী। সৎ মায়ের কু-প্ররোচনায় বাবা রক্তিকে পুঁতে ফেলার নির্দেশ দেন। কথিত আছে, সেই থেকে প্রতি বছর বিয়ের রাতে কুয়ার পাশে একটা রক্তজবার ফুল ফোটে। আর এই ফুল ছিঁড়লে নাকি অমঙ্গল নেমে আসে।

আজকেও সেই রাত। বৃষ্টির জলে ভিজে সেই কুয়ার পাশে ফুটেছে একটা রক্তজবা। টকটকে লাল রঙের ফুলটা যেন নিজেই বলে দিচ্ছে, "আমাকে ছুঁও না"। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আজকের কনে শিউলি। অসম্ভব সুন্দরী, শান্ত স্বভাবের মেয়ে।

বিয়ের সাজে সে যেন অপ্সরী। অতিথিদের সাথে কথা বলতে বলতে সে পেছনের বাগানে চলে আসে। চারদিক নিঝুম। হঠাৎ তার চোখ যায় সেই লাল ফুলটার দিকে। কোনো কিছু না ভেবেই সে ফুলটা ছিঁড়ে নেয়।

ঠিক তখনই আকাশ-বাতাস যেন থমকে যায়। বিদ্যুৎ চমকায় রক্তজবার লাল রঙটা যেন আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। শিউলির হাত কাঁপতে থাকে। একটা অজানা ভয় তার মনকে গ্রাস করে।


এদিকে জমিদার বাড়ির উঠোনে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। বর-কনের মালা বদল হয়ে গেছে। এখন শুধু সাত পাক ঘোরার পালা। কিন্তু শিউলি নেই। সবাই তাকে খুঁজতে থাকে। কেউ বাগানে যায়, কেউ বাড়ির ভেতরে। কিন্তু শিউলির কোনো খোঁজ নেই।

হঠাৎ একটা আর্তনাদ শোনা যায়। শব্দটা আসছে পেছনের বাগান থেকে। সবাই ছুটে যায়। বাগানে গিয়ে দেখে শিউলি মাটিতে পড়ে আছে। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। তার পাশে পড়ে আছে সেই রক্তজবার ফুল।

জমিদার সাহেব শিউলিকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, "কী হয়েছে মা? কেউ কিছু করেছে?"

শিউলি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, "বাবা, আমি কুয়ার পাশে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা লাল ফুল দেখে ছিঁড়ে নিলাম। এরপর..."

"এরপর কী?"

"কুয়াটা... কুয়াটা যেন আমাকে ডাকছে বাবা!"

সবাই শিউলির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু শিউলির অবস্থা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। কেউ কেউ বলতে থাকে, "অমঙ্গল হয়েছে। রক্তি ফিরে এসেছে!"


রাত যত বাড়ছে, শিউলির অবস্থা তত খারাপ হচ্ছে। সে কথা বলতে পারছে না। শুধু কাঁপছে আর কুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকছে। জমিদার বাড়ির বড় বউ ঝর্ণা কিছুটা বুঝতে পারছেন। তিনি একজন ওঝাকে ডেকে আনেন। ওঝা শিউলিকে দেখে বলেন, "এই মেয়েকে ভূত-প্রেতের ছায়া লেগেছে। তাড়াতাড়ি ওঝা-গুণিন ডেকে আনতে হবে।"

ওঝা-গুণিনরা আসে। তারা শিউলির ওপর নানা মন্ত্র-তন্ত্র পড়তে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। শিউলির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। হঠাৎ সে চোখ বন্ধ করে জোরে চিৎকার করে ওঠে।

শিউলির চিৎকার থেমে গেলে ওঝা-গুণিনরা বলে, "এই মেয়ে এখন আর শিউলি নয়। এর শরীরে রক্তি এসেছে।"

"রক্তি? সে তো অনেক আগেই মরে গেছে!"

"মৃতের আত্মা কখনও মরে না। যদি মৃত্যুর সময় কোনো অতৃপ্ত ইচ্ছা থেকে যায়, তাহলে সে আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়।"

"তাহলে এখন কী হবে?"

"রক্তির অতৃপ্ত আত্মাকে শান্ত করতে হবে। নইলে শিউলির জীবন বিপন্ন।"


রক্তির অতৃপ্ত আত্মাকে শান্ত করার জন্য ওঝা-গুণিনরা একটা পূজার আয়োজন করে। সারারাত ধরে চলে সেই পূজা। শেষ পর্যন্ত রক্তির আত্মা শিউলির শরীর থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু তার আগে সে একটা ভয়ঙ্কর ঘোষণা করে।

রক্তির আত্মা বলে,

"আমি রক্তি। এই জমিদার বাড়ির মেয়ে। আমাকে আমার বাবা জীবন্ত পুঁতে মেরেছিলেন। आजকে আমি প্রতিশোধ নিলাম। এই বাড়িতে আজ থেকে আর কোনো বিয়ে হবে না। যে এই বাড়িতে বিয়ে করবে, তার জীবনে নেমে আসবে অমঙ্গল।"

এই কথা বলেই রক্তির আত্মা অদৃশ্য হয়ে যায়। সবাই ভয়ে স্তম্ভ হয়ে যায়। জমিদার বাড়িতে নেমে আসে শোকের ছায়া।


রক্তির অভিশাপ সত্যি হতে থাকে। জমিদার বাড়ির মেজো ছেলের বিয়ে ভেঙে যায়। এরপর থেকে আর কোনো বিয়ে হয়নি এই বাড়িতে। যারা বিয়ে করতে এসেছে, তাদের নানা অমঙ্গল হয়েছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কেউ মারা গেছে।

আস্তে আস্তে বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কেউ আর সেখানে থাকতে চায় না। মানুষজন ভয়ে বাড়িটাকে এড়িয়ে চলে। শুধু মাঝে মাঝে কেউ কেউ কৌউতুহল বশত সেখানে যায়। কিন্তু তারাও ফিরে আসে ভয়ে ভয়ে।

একদিন একদল তরুণ-তরুণী সেই জমিদার বাড়িতে যায়। তারা রক্তির গল্প শুনেছে। কিন্তু বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, এসব বানোয়াট গল্প। তারা ভূতের ভয় দেখিয়ে মানুষকে দূরে রাখতে চায়।

তারা বাড়ির ঘুরে দেখে। সবকিছু এলোমেলো। দেয়ালে ঝুলছে পুরোনো ছবি। সিঁড়িতে জমেছে মাকড়সার জাল। ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। পুরো বাড়িটা যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

হঠাৎ একজন মেয়ে চিৎকার করে ওঠে। সবাই ছুটে যায়। মেয়েটিকে দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। মেয়েটির চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। তার পাশে পড়ে আছে একটা রক্তজবার ফুল।


এই ঘটনার পর সবাই ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারা আর কখনও সেই বাড়িতে যায়নি। আজও সেই জমিদার বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ সেখানে যায় না। শুধু মাঝে মাঝে কুয়ার পাশে একটা রক্তজবার ফুল ফোটে। আর এই ফুল যেন বলে দিচ্ছে, রক্তির প্রতিশোধ এখনও শেষ হয়নি।

এই গল্পটা শুধুই একটা গল্প নয়। এটা একটা সত্য ঘটনা। এটা বাংলার মাটিতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ভৌতিক ঘটনার একটি। এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই, প্রেম, ঘৃणा, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের মতো অনুভূতিগুলো কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।

আমি আশা করি, আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। আমি সবসময় চেষ্টা করি, আমার লেখার মধ্য দিয়ে আপনাদের একটু ভয়, একটু রহস্য উপহার দিতে।

তবে সাবধান! আমার লেখা পড়ার আগে ভালো করে দরজা-জানালা বন্ধ করে নিন। কারণ, আপনি কখন এই গল্পের কোন চরিত্রের সামনে এসে দাঁড়াবেন, তা কেউ জানে না!

Read more