অভিশপ্ত কবিরাজ - The Cursed Healer

ভয়কে পুঁজি করে এক ভুয়া কবিরাজ মানুষকে ঠকাতো। কিন্তু এক খারাপ জ্বীন তার জীবনে নিয়ে আশে দুর্দশা আর ভয়ঙ্কর এক অভিশাপ

অভিশপ্ত কবিরাজ - The Cursed Healer

হালিম কবিরাজ এক ধূর্তবৃত্ত, মানুষের দুঃখকে পুঁজি করে বা অসহায় মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা কামানো ছিল তার একমাত্র কাজ। হালিম কবিরাজের কাছে আসা লোকেরা জানত না, সে জ্বীন তাড়ানোর কোনো কবিরাজ নয়। সে ছিল ধূর্ত ঠকবাজ। রোগীরা তার কাছে আসত আর সে তাদেরকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিত। এরকমই চলছিল মাসের পর মাস।

এক রাতে, তার কাছে এলো এক ভীত চোখের যুবক। তার নাম করিম। করিম কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "কবিরাজ সাহেব, আমি কী বিপদে আছি!" বলে তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে শুরু করে। "ঘুমের মধ্যে কে যেন আমার শ্বাসরোধ করে দিতে চায়। আমি চেঁচাতে পারি না, শুধু কালো, বীভৎস মুখগুলো দেখি, যারা আমাকে অন্ধকারে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে।" সে একটু থেমে আবার বলল, "আর সবসময় নাকে এক অসহ্য দুর্গন্ধ আসে, যেন অনেক দিনের পচা লাশের মতো।"

করিমের কথা শুনে হালিম একটু চমকে গেল। এতদিন সে ভুয়ো মন্ত্রপূত হাবিজাবি দিয়ে মানুষকে বোকা বানাত আর টাকা লুট করত। কিন্তু করিমের চোখের ভয় ছিল আলাদা। একটা অশরীরী শিহরণ কবিরাজ হালিমের মেরুদণ্ডে বয়ে গেল। তবুও সে সাহস দেখানোর চেষ্টা করল। কয়েকটা ভুয়ো মন্ত্র আউড়ে বলল, "আমি আমার আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে দেখতে পাচ্ছি যে তোমাকে এক ভয়ানক খারাপ জ্বীন আছড়ে ধরেছে। অনেক খারাপ অবস্থা, যদি তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না করো তাহলে সে কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে মেরে ফেলবে।"

কবিরাজের কথা শুনে করিম আরও ভয় পেয়ে গেল এবং বলল, "কবিরাজ সাহেব, আমাকে বাঁচান, কি করতে হবে করুন, কিন্তু আমাকে বাঁচান।"

কিন্তু সেই রাতেই হালিমের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। ঘুমোতে যাওয়ার পর থেকেই তার ঘরে অদ্ভুত ঘটনা শুরু হল। কোণে থেকে যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। সে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকারে তার মনে হল বিছানার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না।

এরপর শুরু হল অবিরাম যন্ত্রণা। রাতের পর রাত সে ঘুমোতে পারল না। চোখের সামনে কেবল সেই কালো মুখগুলোই ভাসত। ঘরের দেওয়ালে ছায়া নাচত, আর সেই অসহ্য গন্ধ, যেন পচা গোর থেকে বাতাস এসে তার নাকে ঢুকে যাচ্ছে। তার ভুয়ো মন্ত্র আর কোনো কাজে লাগছিল না। সে জানত, এবার সে আসল ভয়ের মুখোমুখি।

দিনের বেলা সে আর মানুষের সামনে সেই আগের মতো আস্থা দেখাতে পারল না। তার হাত কাঁপছিল, চোখে ছিল ভয়ের ছায়া। গ্রামের মানুষজন ফিসফাস শুরু করল – নিশ্চয়ই কোনো শক্তিশালী জ্বীন তার পিছনে লেগেছে।

একদিন সকালে, আর সহ্য না করতে পেরে হুংকার দিয়ে চিৎকার করে বাড়ির বাইরে ছুটে এলো হালিম। সে চিৎকার করে বলতে লাগল, "জ্বীন! জ্বীন!" তার চোখ ছিল পাগলের মতো, চুলগুলো জট পাকানো। মুখ থেকে ফেনা বেরোচ্ছিল। সে এলোমেলো দিকে দৌড়াতে শুরু করল যতদূর পারে। কিন্তু ভয়টা তাকে অনুসরণ করল। এমনকি দিনের আলোতেও সে ছায়াগুলোকে দেখতে পেল বলে মনে হলো, কেউ কানে কানে তার নাম ধরে ডাকছে।

হালিম ছুটে চলল, ছুটে চলল, কিন্তু তার পিছু ছাড়ল না সেই ভয়াল ছায়াগুলো। তারা যেন তাকে ঘিরে ধরেছিল, তার শরীরের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ সে একটা কুয়োর ধারে এসে পড়ল। মনে হল যেন কুয়োর ভেতর থেকে কেউ তাকে ডাকছে। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, ঝাঁপ দিল কুয়োর ভেতর।

কুয়োর ঠান্ডা জলে ডুবে যেতে যেতে হালিমের চোখের সামনে ভেসে উঠল তার জীবনের সব পাপ। সে যত মানুষকে ঠকিয়েছে, যত অসহায় মানুষের কষ্টের উপর ভোজবাজি করেছে, সবকিছু। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। জল তার মুখ, নাক, কান সব ঢেকে ফেলল।

হালিম কবিরাজের এই পরিণতি দেখে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল অসাধু লোকটিকে শেষ পর্যন্ত তার হীন কাজের ফল ভোগ করতে হয়েছে। নকল মন্ত্রপূত আর কবিরাজি করে কত যে মানুষকে সে ঠকিয়েছিল! কিন্তু আসল জ্বীন যেসব চোখে অদৃশ্য তাদের ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। তারা তাদের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে।

আর যুবক করিম? হালিমের কুয়োয় ঝাঁপ দেওয়ার পর, করিমের উপর থেকে যেন এক নিমিষেই সব ভয় উঠে গেল। তার আর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখা দিল না, নাকে আর সেই পচা গন্ধও এলো না। সে বুঝতে পারল, যে জ্বীন হালিমকে শাস্তি দিয়েছে, সে-ই তাকে বাঁচিয়েছে। করিম নতুন করে জীবন শুরু করল, আর কখনো ভূত-প্রেতের ভয় পেল না।

তারপর আস্তে আস্তে হালিম পাগল কবিরাজের গল্প শুধু কথার কথাই হয়ে রইল। আর যুবক করিম? তার সাহসিকতার কথা এখনো মাঝেমধ্যে গল্পের আসরে উঠে আসে। লোকেরা বলে, করিম নাকি পরে অনেক বড় একজন গুণী মানুষ হয়েছিল। তার মনে আর কোনো ভয় ছিল না, ছিল শুধু সাহস আর দৃঢ়তা।

কিন্তু হালিম কবিরাজের কথা? গ্রামের লোকজন এখনো কখনো কখনো রাতের বেলায় কুয়োর ধার দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পায়। যেন কেউ জলের তলা থেকে "জ্বীন! জ্বীন!" বলে চিৎকার করছে। আর কুয়োর পাশের ঝোপ-জঙ্গলে যেন কালো ছায়া নাচানাচি করছে। হালিমের ভয় যেন এখনো সেই কুয়োতে বন্দি হয়ে আছে, গ্রামবাসীদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে।

এই ছিল হালিম কবিরাজের গল্প। একজন ধূর্ত ঠকবাজের অন্ত যে কত ভয়াবহ হতে পারে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

Read more

সুন্দরবনের ভূতের গল্প: হারিয়ে যাওয়া পথ

সুন্দরবনের ভূতের গল্প: হারিয়ে যাওয়া পথ

শীতের এক সকাল। ঢাকা থেকে আসা একটি পরিবার - বাবা আসিফ, মা তানিয়া, এবং তাদের দুই সন্তান রিমি ও রনি - সুন্দরবনে বনভোজনে এসেছে। সকাল থেকেই

By কা,আন