দৈত্যের গুহা | The cave of the monster
অধ্যায় ১: অভিযানের সূচনা
বৃষ্টির পর সন্ধ্যে নামছে চট্টগ্রামের পাহাড়ি গ্রাম চন্দ্রকোনায়। বাতাসে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের গন্ধ। বাড়ির উঠানে বসে চার বন্ধু - রিপন, রনি, তানিম, আর নীলা - আড্ডা দিচ্ছে। আলোচনার বিষয়, অবশ্যই, সেই ভয়ঙ্কর 'দৈত্যের গুহা'।
"আজকে রাতে চল, ওই গুহায় যাই," রিপন বললো।
"আরে পাগল, সেখানে তো ভূত আছে!" চোখ বড় বড় করে বললো নীলা।
"ভূত-টূত কিছু নেই রে," হেসে উড়িয়ে দিলো রনি।
"আমার তো ভয় করছে, যাবো না," ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো তানিম।
"আরে বোকার দল," রিপন বললো, "আমরা তো শুধু দেখতে যাবো, কিছু করবো না। আর তাছাড়া, দৈত্যের গুহার গল্প সবই তো গাঁজাখুরি!"
"তবুও..." তানিম এখনও দ্বিধান্বিত।
"আরে বাবা," রনি তানিমের কাঁধে হাত রেখে বললো, "আমরা চারজন একসাথে থাকবো। কোনো ভূতের সাহস নেই আমাদের কিছু করার।"
রিপন, রনি আর নীলার জোরাজুরিতে অবশেষে তানিম রাজি হলো। সন্ধ্যা নামতেই চার বন্ধু বেরিয়ে পড়লো অভিযানে।
অধ্যায় ২: নিঝুম পাহাড়, গুহার অন্ধকার
একটু পরেই পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়লো। চার বন্ধু গ্রামের শেষ প্রান্তে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে পা বাড়ালো। পাহাড়ের পথ খুবই দুর্গম। ঘন জঙ্গল, পিচ্ছিল মাটি, মাঝেমধ্যে দু'একটা বন্যপ্রাণীর ডাক।
তবে চার বন্ধু দমে যায়নি। ভয়কে জয় করে তারা এগিয়েছে। ঘণ্টাখানেক পর, অবশেষে তারা পৌঁছে গেলো গুহার মুখে।
প্রকাণ্ড গুহার মুখ অন্ধকারে ঢেকে আছে। ভেতর থেকে আসছে শীতল বাতাসের ঝাপটা। একবার ভেতরে তাকিয়ে নীলা আবার ভয় পেয়ে গেলো।
"এবার তো আর ফিরে যাওয়া যাবে না," রিপন বললো, "এতো কষ্ট করে এসেছি। চলো, ভেতরে যাই।"
একটা টর্চ জ্বালিয়ে রনি সবার আগে গুহার ভেতর ঢুকলো। বাকিরাও তার পিছু পিছু ঢুকলো।
অধ্যায় ৩: গুহার ভেতর, দানবের আবির্ভাব
গুহার ভেতরটা বেশ প্রশস্ত। দেয়ালে লেগে আছে শ্যাওলা, ছাদ থেকে ঝুলছে বাদুড়। ভেতরের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।
"এই যে," রিপন ডাকলো, "কেউ আছো?"
কোনো সাড়া নেই। শুধু নিজেদের পায়ের আওয়াজ আর বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
"এখানে তো কিছুই নেই," রনি বললো।
"এতো সহজে হাল ছেড়ে দিবি না," রিপন বললো, "আরও ভেতরে যাই।"
এগিয়ে যেতে যেতে তারা এলো একটা বিশাল হলঘরে। হলঘরের মাঝখানে একটা বড় আগুন জ্বলছে। আগুনের আলোয় দেখা যাচ্ছে, দেয়ালে আঁকা আছে অদ্ভুত সব চিত্র।
"দেখো," তানিম আঁতকে উঠে বললো, "ওই দেয়ালে কি আছে!"
সবাই তাকিয়ে দেখলো, দেয়ালে আঁকা একটা বিশাল দানবের ছবি। দানবের চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে।
"ভয় পেয়ো না," রিপন বললো, "এটা শুধু ছবি।"
কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই, হঠাৎ আগুনের শিখা নিভে গেলো। পুরো হলঘর অন্ধকারে ঢেকে গেলো।
"আরে," রনি বললো, "কি হলো?"
"আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না," নীলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো।
হঠাৎ, একটা ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা গেলো। গুহার ভেতর প্রতিধ্বনিত হলো সেই গর্জন।
"কে? কে সেখানে?" রিপন চিৎকার করে বললো।
কোনো উত্তর নেই। আবার শোনা গেলো সেই ভয়ঙ্কর গর্জন।
হঠাৎ, টর্চের আলোয় দেখা গেলো, হলঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল দানব। লোমশ দেহ, ভয়ঙ্কর চোখ, তীক্ষ্ণ নখ।
"ভূ... ভূত!" চিৎকার করে উঠলো নীলা।
"দৌড়!" রিপন চিৎকার করে বললো।
অধ্যায় ৪: পালানোর চেষ্টা, আটকে যাওয়া
চার বন্ধু প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। কিন্তু দানব তাদের পিছু ধাওয়া করছে।
ওদিকে!" রনি একটা গলির দিকে ইশারা করে বললো।
বন্ধুরা গলি দিয়ে দৌড়াতে লাগল। গলিটা খুবই সরু, দু'জন পাশাপাশি যেতে পারছে না। তবুও তারা দৌড়াচ্ছে, যেন প্রাণ বাঁচাতে।
পেছন থেকে দানবের গর্জন আরও কাছে আসছে। তারা বুঝতে পারছে, দানব তাদের ধরে ফেলবে।
হঠাৎ, গলির শেষ প্রান্তে এসে তারা থমকে গেলো। তাদের সামনে একটা বিশাল দেয়াল।
"এখন কি হবে?" নীলা কান্না জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
"একটা উপায় আছে," রিপন বললো, "আমরা দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে পারি।"
"কিন্তু এতো উঁচু দেয়াল কি করে উঠবো?" তানিম জিজ্ঞেস করলো।
"আমাদের আর কোনো উপায় নেই," রিপন বললো, "চেষ্টা করে দেখতে হবে।"
রিপন দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করলো। বাকিরাও তার পিছু পিছু উঠলো।
কিন্তু দেয়ালটা খুবই পিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর রনি পিছলে পড়ে গেলো।
"আমি পারছি না," রনি বললো, "আমাকে ফেলে চলে যাও।"
"কখনোই না," রিপন বললো, "আমরা কাউকে ফেলে যাবো না।"
রিপন রনিকে টেনে তুললো। তারপর চারজন আবার উঠতে শুরু করলো।
কিন্তু ততক্ষণে দানব এসে পৌঁছেছে তাদের পিছনে। সে তার বিশাল হাত বাড়িয়ে রিপনকে ধরলো।
রিপন চিৎকার করে উঠলো। বাকিরাও ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
"এখন কি হবে?" নীলা আবার কান্না জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
"আমি জানি না," রিপন বললো, "কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দেবো না।"
অধ্যায় ৫: অপ্রত্যাশিত মোড়, আশার আলো
দানব রিপনকে টেনে নিচে নামিয়ে আনলো। রিপন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সে ভাবলো, এবার তার শেষ।
কিন্তু দানব তাকে কিছু করলো না। সে রিপনকে তার বিশাল কাঁধে বসিয়ে হলঘরের দিকে নিয়ে গেলো।
বাকিরা তাদের পিছু পিছু গেলো। তারা বুঝতে পারছিলো না, দানব আসলে কি করতে চায়।
হলঘরে পৌঁছে দানব রিপনকে নামিয়ে দিলো। তারপর সে আগুন জ্বালালো। আগুনের আলোয় দেখা গেলো, দানবের চোখে কোনো রাগ নেই, বরং এক ধরনের মায়া।
"তোমরা এখানে কি করছো?" দানব গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
রিপন সব কথা খুলে বললো। সে বললো, কিভাবে তারা গুহায় এসেছিল, কিভাবে দানব তাদের আক্রমণ করেছিল।
দানব চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর সে বললো, "তোমরা খুব সাহসী। কিন্তু এই গুহায় আসা তোমাদের উচিত হয়নি। এই গুহা আমার। আমি এখানে একা থাকি। তোমাদের উপস্থিতি আমাকে বিরক্ত করে।"
"আমরা ক্ষমা চাচ্ছি," রিপন বললো, "আমরা এখান থেকে চলে যাবো।"
"না," দানব বললো, "তোমাদের এখান থেকে যেতে হবে না। আমি তোমাদের একটা প্রস্তাব দিচ্ছি।"
অধ্যায় ৬: দানবের প্রস্তাব, অজানার পথে
"আমি তোমাদের আমার গুহায় থাকতে দেবো," দানব বললো, "তবে একটা শর্তে। তোমাদের আমাকে আমার কাজে সাহায্য করতে হবে।"
"কি কাজ?" রনি জিজ্ঞেস করলো।
"এটা একটা গোপন কাজ," দানব বললো, "আমি তোমাদের সব বলতে পারবো না। তবে এটা তোমাদের জন্য খুবই উপকারী হবে।"
"আমরা কি করে তোমাকে বিশ্বাস করবো?" নীলা জিজ্ঞেস করলো।
"তোমাদের বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই," দানব বললো, "আমি তোমাদের ক্ষতি করতে চাই না। আমি শুধু চাই, তোমরা আমাকে সাহায্য করো।"
চার বন্ধু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর রিপন বললো, "আমরা তোমার প্রস্তাব শুনতে চাই। "
"খুব ভালো," দানব বললো, "তাহলে তোমরা এখানে থেকে যাও।"
দানব তাদের একটা ঘর দেখিয়ে দিলো। সেখানে তারা রাত কাটালো।
দানব তাদের তার কাজের কথা বলতে শুরু করলো।
"আমি এই পাহাড়ের রক্ষক," সে বললো। "আমার দায়িত্ব এই পাহাড়ের সম্পদ রক্ষা করা। কিন্তু কিছু লোভী মানুষ এই পাহাড়ের সম্পদ লুট করতে আসে। আমি তাদের আটকাই। কিন্তু আমি একা সব কিছু সামলাতে পারি না।"
"তাহলে আমরা কি করবো?" রিপন জিজ্ঞেস করলো।
"তোমরা আমার চোখ-কান হয়ে কাজ করবে।" দানব বললো, "তোমরা এই পাহাড়ের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে। যদি কাউকে সন্দেহজনক কিছু করতে দেখো, তাহলে আমাকে খবর দেবে।"
"কিন্তু আমরা তো তোমার মতো শক্তিশালী নই," তানিম বললো।
"তোমাদের শক্তিশালী হতে হবে না," দানব বললো, "তোমাদের শুধু বুদ্ধিমান হতে হবে।"
চার বন্ধু রাজি হয়ে গেল। তারা দানবের কথা মতো পাহাড়ের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
একদিন, তারা একদল লোককে পাহাড়ের গাছ কাটতে দেখলো। লোকগুলোর কাছে ছিলো কুড়াল, করাত আর অন্যান্য অস্ত্র।
"ওরা নিশ্চয়ই লোভী মানুষ," রিপন বললো, "আমাদের দানবকে খবর দিতে হবে।"
তারা দৌড়ে দানবের কাছে গেলো। দানব তাদের কথা শুনে রেগে গেলো। সে তাদের সাথে নিয়ে লোকগুলোর কাছে গেলো।
দানবকে দেখে লোকগুলো ভয় পেয়ে গেলো। তারা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু দানব তাদের ধরে ফেললো।
"তোমরা কি করছো?" দানব গর্জে উঠলো।
"আমরা... আমরা শুধু গাছ কাটছিলাম," একজন লোক কাঁপতে কাঁপতে বললো।
"গাছ কাটা অপরাধ," দানব বললো, "তোমাদের শাস্তি হবে।"
দানব লোকগুলোকে পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দিলো। তারপর সে চার বন্ধুকে বললো, "তোমরা খুব ভালো কাজ করেছো।"
চার বন্ধু খুশি হলো। তারা বুঝতে পারলো, দানব আসলে খারাপ নয়। সে শুধু পাহাড়ের রক্ষক।
অধ্যায় ৭: দানবের গোপন কাজ, রহস্যের উন্মোচন
দিনের পর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। চার বন্ধু দানবের সাথে থেকে তার কাজে সাহায্য করছে। তারা দানবকে আরও ভালো করে চিনতে পারছে। দানব তাদের অনেক গল্প শোনাচ্ছে। সে তাদের পাহাড়ের ইতিহাস, গাছপালার নাম, প্রাণীদের আচরণ সম্পর্কে শেখাচ্ছে।
একদিন, দানব চার বন্ধুকে একটা গোপন জায়গায় নিয়ে গেলো। সেখানে একটা সুন্দর ঝর্ণা ছিলো। ঝর্ণার পাশে একটা গুহার মুখ।
"এই গুহায় একটা গোপন রহস্য আছে," দানব বললো, "আমি চাই, তোমরা এটা খুঁজে বের করো।"
চার বন্ধু গুহায় ঢুকলো। গুহাটা বেশ অন্ধকার ছিলো। তারা টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর তারা একটা বিশাল হলঘরে এসে পৌঁছালো। হলঘরের মাঝখানে একটা সোনার মূর্তি ছিলো।
"এই তো সেই রহস্য," রিপন বললো, "এই মূর্তিটা নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান।"
"হ্যাঁ," দানব বললো, "এই মূর্তিটা আমার পূর্বপুরুষদের তৈরি। এটা এই পাহাড়ের সম্পদ। আমি এটা রক্ষা করতে চাই।"
"কিন্তু কিভাবে?" তানিম জিজ্ঞেস করলো।
"এই মূর্তিটার একটা গোপন শক্তি আছে," দানব বললো, "এটা যদি কেউ চুরি করে, তাহলে পাহাড়ের সর্বনাশ হবে।"
"তাহলে আমরা এটা কি করবো?" রনি জিজ্ঞেস করলো।
"আমরা এটা লুকিয়ে রাখবো," দানব বললো, "এমন একটা জায়গায়, যেখানে কেউ এটা খুঁজে পাবে না।"
চার বন্ধু দানবকে সাহায্য করলো মূর্তিটা লুকিয়ে রাখতে। তারপর তারা গুহা থেকে বেরিয়ে এলো।
"তোমরা আবার আমাকে বাঁচিয়ে দিলে," দানব বললো, "আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।"
চার বন্ধু খুশি হলো। তারা বুঝতে পারলো, দানব তাদের বন্ধু।
অধ্যায় ৮: বিদায়ের বেলা, নতুন শুরু
কিছুদিন পর, চার বন্ধু ঠিক করলো, তারা তাদের গ্রামে ফিরে যাবে।
"আমরা তোমাকে মিস করবো," রিপন দানবকে বললো।
"আমিও তোমাদের মিস করবো," দানব বললো, "কিন্তু তোমাদের এখন যেতে হবে। তোমাদের নিজেদের জীবন আছে।"
চার বন্ধু দানবকে বিদায় জানিয়ে গ্রামে ফিরে গেলো। তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বললো না। কারণ, তারা জানতো, কেউ তাদের বিশ্বাস করবে না।
তবে তারা দানবের কথা কখনো ভুলতে পারেনি। তারা জানতো, দানব এখনও পাহাড়ে আছে, পাহাড়ের সম্পদ রক্ষা করছে।
এবং তারা জানতো, তারা যদি কখনো বিপদে পড়ে, তাহলে দানব তাদের সাহায্য করতে আসবে।