গলা কাটা ছায়া
বাংলাদেশের লোককথায় বেশ পরিচিত 'গলা কাটা চায়া', বা গলা কাটা ভূত। এর সম্পর্কে বিভিন্ন এলাকায় কাহিনীটা একটু একটু ভিন্ন হতে পারে
রাঙামাটির কোন এক গ্রাম, সবুজে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলেছে মিনতি আর তার ছোট ভাই সুমন। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল তারা। কিন্তু আজ তাদের ফেরার পথে যেন অন্যদিনের থেকে কিছু একটা ভিন্ন।
সন্ধ্যার আলো গাঢ় হতে শুরু করেছে। কার্তিকের শেষের দিকের পড়ন্ত বিকেলের রোদটা নরম হয়ে এসেছে, হাওয়ায় কেমন শীতের আমেজ। এগিয়ে যেতে যেতে মিনতি লক্ষ্য করলো, আজ যেন এক অদ্ভুত নীরবতা চারিদিকে। পাখির কিচিরমিচির নেই, গ্রামের বাইরের কচুক্ষেতে বকেরাও ডাকছে না। যে গাছটির ডালে মিনতি নিয়ম করে কাকদের ঝগড়া দেখতে, সেখানেও সব নিস্তব্ধ।
"দিদি, ভয় করছে তোর?" সুমনের ভয়ার্ত গলা শুনে চমকে উঠল মিনতি।
"না, আমি ভয় পাচ্ছি না! একটু আধটু ভয় লাগতেই পারে, ভূত তো বলে নাই যে আসতে পারবে না।" মিনতি ভাইকে সাহস দিয়ে বললো।
লোকমুখে কথা
এই গ্রামে সেই অদ্ভুত ভূতের কথা গত কয়েক মাস ধরেই চলছে। কেউ নাকি রাতের বেলায় নির্জন রাস্তায় চলতে গিয়ে ঠিক পিছন দিক থেকে হঠাৎ গলা চেপে ধরে ফেলে। তাকিয়ে দেখার সাহস কেউ পায় না। সুমন তো কান দুটো হাত দিয়ে চেপে বলেই ফেললো, "সে নাকি গলাই কেটে নেয় দিদি! সেজন্যেই ওর নাম..."
"সে সব বাজে কথা।" সুমনের মাঝপথে কথা বন্ধ করতে করতে বলল মিনতি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মিনতিরও গা ছমছম করে উঠলো।
গোধূলীর ছায়া
সূর্যটা পুরোপুরি ঢলে যাওয়ার আগেই তারা যেন আরও তাড়াতাড়ি পা চালায়। পথের দুপাশে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ উচুনিচু পাহাড় আর টিলা। হঠাৎ করেই যেন বাতাসটা থেমে গেলো। একটা কাক কোথা থেকে কা-কা করে উড়ে গেল।
পিছনে টান অনুভব করল মিনতি। "সুমন, ছাড় দুষ্টমি করিস না!" বলে সে পিছনে ফিরল। কিন্তু সুমন সেখানে নেই। "সুমন? কই গেলি তুই?" চারপাশে তাকায় মিনতি, কিন্তু সুমন কোথাও নেই।
আতঙ্কিত মিনতি সুমনের নাম ধরে ডাকতে থাকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় গলা কাটা ছায়ার গল্প। হিম হয়ে আসে তার রক্ত। তার ডাকের উত্তর কেউ দেয় না। কেবল পশ্চিম আকাশের গাঢ় লালে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ উঠছে, আর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
ভয় নাকি সত্যি?
ঠিক তখনই মিনতির কানে আসে চাপা হাসির আওয়াজ। হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া, কর্কশ একটা হাসি! সেই হাসির সঙ্গে আরও শোনা যায় যেন কারো সুনিঃশব্দ পায়ের শব্দ। কে আসছে তার পিছু পিছু? গ্রামের গল্পগুলো কি তবে সত্যি? মিনতির হৃদপিণ্ড যেন বুকের ভেতর আটকে গেছে।
এমন সময় সে আলো দেখতে পায় গ্রামের প্রবেশপথে। মিনতি দৌড়ে সেখানকার দিকে ছুটলো। প্রাণপণে সে দৌড়োচ্ছে, আর পিছন থেকে, বাস্তব না কল্পনা সে বুঝতে পারছেনা, কিন্তু ভয়কে জয় করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে মিনতি থামছে না, ছুটছেই!
হাঁপাতে হাঁপাতে গ্রামে পৌঁছেই সে দেখলো, গ্রামের মোড়ে ভিড় জমে আছে। "সুমন!" চিৎকার করে উঠল সে।
ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল মিনতি। মাটিতে পড়ে ছিল সুমন। তার চোখ, মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে।
"কী হয়েছে ওর? কেউ কিছু বলছো না কেন?" চিৎকার করে ওঠে মিনতি।
এক বৃদ্ধ মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, "এই খানে পড়েছিল ছেলেটা। বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো ভয় পেয়েছে বড্ড।"
মিনতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
"আমাদের এই গ্রামের বাইরে আলোর পরে কেউ একা থাকতে সাহস করে না মা। গলা কাটা ছায়ার গল্প তো শুনেছোই!" বৃদ্ধা মিনতির মাথায় হাত রাখলেন।
মিনতি ভাইকে ধরে বাড়ির দিকে রওনা হল। পিছনে ফেলে আসা গোধূলির আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলে ঘেরা পথ। কিন্তু সুমনের সাথে কি ঘটেছিল সেটা ...! আর জানা গেলো না।