প্যারিসের ক্যাটাকম্বস: মৃত্যুর নগরীর গল্প (Catacombs of Paris)
প্যারিস, "আলোর শহর," "ভালোবাসার শহর"—যার নামেই ডাকি না কেন, প্যারিসের মুগ্ধতা সব সময়েই অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু এই শহরের ভেতরে, উজ্জ্বল আলোর নিচে লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকারের রহস্য, যার কথা অনেকেরই জানা নেই।
এই রহস্য লুকিয়ে আছে প্যারিসের নিচের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে, এক রহস্যময় জগৎ—ক্যাটাকম্বস। লাখো মানুষের কঙ্কাল সমাধিস্থ করা এই সুড়ঙ্গ যেন মৃত্যুর নিঃশব্দ রাজত্বের দরজা।
ক্যাটাকম্বসের ইতিহাস দীর্ঘ এবং ভীতিপূর্ণ। আঠারো শতকের শেষের দিকে, প্যারিসের প্রধান কবরস্থানগুলোতে মৃতদেহের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে থাকে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় এই অতিরিক্ত মৃতদেহগুলিকে এক জায়গায় স্থানান্তর করবে। তখনই সৃষ্টি হয় ক্যাটাকম্বস।
প্যারিসের নিচের এই গুহাগুলোতে শহরের অগণিত কঙ্কাল সাজিয়ে রাখা হয়। এই সুড়ঙ্গে যারা প্রবেশ করে, তারা অনুভব করে যেন সময়ের গভীর অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নিঃশব্দে লাখ লাখ কঙ্কাল থেকে এক অজানা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে এই স্থানটিতে ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত হয়েছে। কেউ বলে এখানে রাতের বেলা অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, যেন নিঃশ্বাসের শব্দ বা ধ্বনির মতো কিছু ভেসে আসে।
অনেকে বলে তারা ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েছে—অনেকটা মানুষের মতো কিন্তু অস্পষ্ট। আবার কেউ কেউ বলে তাদের পেছনে যেন অদৃশ্য কেউ পা ফেলে আসছে, যা কোনোভাবেই ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
এমনই একদিন, কৌতূহলের তাড়নায় একদল তরুণ-তরুণী সিদ্ধান্ত নেয় এই রহস্যময় ক্যাটাকম্বসে প্রবেশ করবে। এই দলে ছিল পিয়েরে, একজন ইতিহাসের ছাত্র, যার প্যারিসের ইতিহাস এবং রহস্যময় স্থানগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ সীমাহীন।
তার সাথে ছিল বান্ধবী ক্লারা এবং তাদের প্রিয় বন্ধু জ্যাক, যে কিছুটা ভীতু হলেও সঙ্গ দিতে প্রস্তুত ছিল। তারা একজোট হয়ে একসাথে এই অভিযানের পরিকল্পনা করে এবং এক সন্ধ্যায় ক্যাটাকম্বসের প্রবেশপথে এসে দাঁড়ায়।
প্রবেশপথের সামনে তারা দেখতে পেল একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে।
এতে লেখা - "থামুন! এখানে মৃত্যুর রাজত্ব।"
এই সতর্কতা তাদের কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু একসাথে তিনজন সাহস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকতেই তারা অনুভব করে এক নিস্তব্ধ ঠান্ডা, যেন বাতাসে জমে থাকা ভয়ের গন্ধ।
চারপাশে হাজার হাজার কঙ্কাল, যা সুড়ঙ্গের দেয়াল এবং ছাদের উপর স্তরে স্তরে সাজানো। তাদের একমাত্র আলো ছিল হাতে থাকা ছোট টর্চ, যা অন্ধকারের মধ্যে সামান্য পরিসর উজ্জ্বল করে।
তারা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর পর, হঠাৎ ক্লারা একটি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল।
"দেখো!"
সে থেমে থাকা এক ছায়ার দিকে ইশারা করল। দেয়ালে একটা অদ্ভুত ছায়া নড়ছে, যা স্পষ্টভাবে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্লারার চোখে ভয়ের ছাপ, আর জ্যাক ইতিমধ্যেই পিছিয়ে এসেছে। কিন্তু পিয়েরে, কৌতূহল প্রবল, টর্চ নিয়ে সাহসের সাথে ছায়াটির দিকে এগিয়ে যায়।
কাছে গিয়ে পিয়েরে দেখতে পেল ছায়াটি আসলে এক মানুষের মতো আকৃতি, কিন্তু তার চোখ দুটি ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা এবং মুখ ছিল স্থির, যেন কোনো যান্ত্রিক পুতুল। তার সারা শরীর কাঁপছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মাটি থেকে না উঠে শূন্যে ভাসছে।
জ্যাক ভয়ে বলতে লাগল, “চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই!”
কিন্তু পিয়েরে অদ্ভুত সেই রূপটিকে স্পষ্টভাবে দেখতে চায়। কাছে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল এটি কোনো সাধারণ মানুষ নয়। এই অস্পষ্ট, সাদা দেহটি হয়ত সেই মৃত আত্মাদের মধ্যে একজন, যারা ক্যাটাকম্বসে অনন্তকালের জন্য বাস করে। হঠাৎ সেই ছায়ামূর্তি পিয়েরের দিকে দ্রুত এগিয়ে এলো।
পিয়েরে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সুরঙ্গের পিচ্ছিল মাটিতে পিছলে গিয়ে পড়ে যায়, আর ছায়ামূর্তি ক্রমশ কাছে আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার মনের ওপর অন্ধকার নেমে আসে এবং সে জ্ঞান হারায়।
জ্ঞান ফিরে এলে পিয়েরে নিজেকে একটি ছোট ঘরে আবিষ্কার করে। তার পাশে বসে আছে ক্লারা এবং জ্যাক।
ক্লারা উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছো?” পিয়েরে মৃদু সাড়া দেয়।
কিন্তু তার চোখে এখনও সেই রহস্যময় মূর্তির ভয়, সেই শূন্য চোখের দৃষ্টি।
তারা বুঝতে পারে, ক্যাটাকম্বসের ভেতরে আর বেশি সময় কাটানো ঠিক হবে না। তিনজনে একত্রে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বের হয়ে আসার পথে হঠাৎ আবার সেই ছায়ামূর্তি তাদের চোখে পড়ে, দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে।
তিনজনেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত দৌড়ে বাইরে আসে, আর প্যারিসের বাতাসে পৌঁছেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
এই ঘটনার পর পিয়েরে ক্যাটাকম্বস সম্পর্কে গবেষণা শুরু করে। সে জানতে পারে, এখানে বহু শতাব্দী ধরে অনেক মানুষ হারিয়ে গিয়েছে।
লোককথা বলে, এই আত্মাগুলো আজও সেখানেই ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ বলে, ক্যাটাকম্বসের জায়গাটি একসময় ছিল এক গির্জার ভূমি।
সেই গির্জাটি ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানে ক্যাটাকম্বস নির্মাণ করা হয় এবং কিছু মানুষ বিশ্বাস করে, সেই গির্জার পুরোহিতদের আত্মাই আজও এখানে ঘুরে বেড়ায়।
পিয়েরে বুঝতে পারে, ক্যাটাকম্বস শুধু মৃতদেহের স্তুপ নয়, বরং এক অভিশপ্ত স্থান। যারা এই জায়গায় চিরতরে বিশ্রামে রয়েছে, তারা যেন এখনও সজাগ আছে, যেন তাদের অন্তিম নিদ্রার পবিত্রতা লঙ্ঘন করতে কেউ প্রবেশ করলে তাকে শাস্তি দেবে।
পিয়েরে তার অভিজ্ঞতা কাউকে জানায় না, কারণ সে চায় না আর কেউ এই ভয়ানক অভিজ্ঞতা লাভ করুক।