সিলেটের রাতের ট্রেন
শীতের সন্ধ্যা। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন, যেখানে সবসময় মানুষের ভিড়ে ঠাসাঠাসি, সেদিন যেন অস্বাভাবিকভাবে নীরব ছিল। ঘন কুয়াশা ঢেকে ছিল চারপাশ। ঠান্ডা হাওয়া যেন হাড় কাঁপানো শীতলতা বহন করে আনছিল।
রিনা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সিলেটের শেষ ট্রেন ধরার জন্য ছুটছিল। সারা সপ্তাহ অফিসের কাজের চাপে সে খুব ক্লান্ত ছিল। এখন শুধু বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর অপেক্ষা।
স্টেশনে পৌঁছে রিনা অবাক হয়ে গেল। চিরচেনা হৈচৈ কোথায়? স্টেশন যেন ভূতুড়ে শহর। কয়েকজন মাত্র যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে রিনা দ্রুত তার কামরায় ঢুকে পড়ল।
কামরাটা প্রায় ফাঁকা। রিনা ছাড়া আর মাত্র দু-একজন যাত্রী। রিনার মনে একটা অজানা ভয় কাজ করতে লাগল। কিন্তু সে মন কে বোঝালো, "হয়তো শেষ ট্রেন বলে যাত্রী কম।"
ট্রেন ছাড়ল। ঢাকার আলো ঝলমলে রাস্তা পেছনে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেন এগিয়ে চলছে অন্ধকারের দিকে। রিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সে চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে রিনার ঘুম ভাঙল। "ফিস...ফিস..." কেমন যেন অনেকগুলো মানুষ একসাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। রিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কুয়াশার মধ্যে কিছু ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। তাদের মুখগুলো অস্পষ্ট, চোখের জায়গায় শুধু কালো গর্ত।
রিনার মনে ভয় ঢুকে গেল। সে কন্ডাক্টরকে খুঁজতে বেরোল। কিন্তু কোথাও কন্ডাক্টরকে পেল না। অন্য কোন যাত্রীকেও পেল না। সব কামরা ফাঁকা।
রিনা আবার তার সিটে বসে পড়ল। হঠাৎ ট্রেনটা জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। রিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ট্রেনটা একটা অজানা জায়গায় থেমে আছে। চারপাশে শুধু অন্ধকার।
কিছু দূরে রিনা আবার সেই ছায়ামূর্তিগুলো দেখতে পেল। তারা ট্রেনের দিকে এগিয়ে আসছে। রিনা দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু দরজা যেন আটকে গেছে।
হঠাৎ রিনার পিছনে কারো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখের সামনে একটা ছায়ামূর্তি—একটি মেয়ে, ভেজা চুল, সাদা কাপড়ে ঢাকা, মুখ অস্পষ্ট। সেই মেয়েটির ফাঁকা চোখদুটো সরাসরি রিনার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটি কিছু বলল না। শুধু তার ঠোঁটের কোণে একটা ভয়ংকর হাসি ফুটে উঠল। রিনা পেছন দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মেয়েটি এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
রিনা তখন আরও কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। "আমাদের সাথে চলো... আমাদের সাথে চলো..." কণ্ঠস্বরগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল, "আমরা সবাই এই ট্রেনে ছিলাম... যে রাতে আমাদের দুর্ঘটনা ঘটেছিল..."
রিনা বুঝতে পারল, এই ট্রেনটা কোন সাধারণ ট্রেন নয়। এটা সেই অভিশপ্ত ট্রেন, যা কয়েক বছর আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় যারা মারা গিয়েছিল, তাদের আত্মা এখনও এই ট্রেনে ঘুরে বেরায়।
রিনা চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু পারল না। মেয়েটি একদম কাছে এসে গেছে। রিনা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। চারপাশ ঘোলাটে হয়ে গেল। রিনার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারল, সে আর বাঁচবে না।
ট্রেনটা কোথায় থামল, কেউ জানে না। সিলেট স্টেশনে ট্রেনটা পৌঁছালে রিনার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। তার কামরা ফাঁকা।
এখনও লোকে বলে, সেই ট্রেন এখনও কমলাপুর থেকে সিলেট যায়। কিন্তু এখন আর কেউ সেই শেষ ট্রেনে যাত্রা করতে চায় না। যারা কাজের তার জন্য বাধ্য হয়ে যাত্রা করে, তারাও সন্ধ্যার আগেই নেমে যায়। রাতের বেলা সেই ট্রেন যেন ভূতের রাজ্যে পরিণত হয়।
রিনার হারিয়ে যাওয়ার পর ট্রেনের কর্মচারীদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে চাকরি ছেড়ে দেয়। যারা থাকে, তারা রাতের বেলা ট্রেনে একাই থাকতে ভয় পায়। তারা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়, ছায়ামূর্তি দেখতে পায়।
এক ড্রাইভার বলল, রাতের বেলা ট্রেন চালাতে গিয়ে সে ট্রেনের সামনে একটা মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল। মেয়েটির চুল ভেজা ছিল, সাদা পোশাক পরে ছিল। মেয়েটি ট্রেনের দিকে হাত নিয়ে ছুটে আসছিল। ড্রাইভার ভয়ে ব্রেক মারে, কিন্তু ট্রেন থামে না। ট্রেন মেয়েটির উপর দিয়ে চলে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটি আবার ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ড্রাইভার ভয়ে চিৎকার করে উঠে।
এই ধরণের অনেক গল্প প্রচলিত আছে সেই ট্রেন নিয়ে। লোকে বলে, সেই ট্রেনে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের আত্মা এখনও সেই ট্রেনেই বাস করে। তারা নাকি নতুন যাত্রীদের খোঁজে থাকে।
কিছু লোক এই ট্রেন নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিল। তারা রাতের বেলা ট্রেনে যাত্রা করেছিল ভূতের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে। কিন্তু তাদের কেউ কোন প্রমাণ পায়নি। তবে তারা সবাই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। তারা অদ্ভুত শব্দ শুনেছে, ছায়ামূর্তি দেখেছে।
এই ট্রেন এখন রহস্যে ঘেরা। কেউ জানে না আসলে কি ঘটে সেই ট্রেনে। কিন্তু একটা কথা সত্যি, সেই ট্রেন আর কোন সাধারণ ট্রেন নয়। সে একটা অভিশপ্ত ট্রেন।