ভয়ংকর অ্যাম্বুলেন্স

ভয়ংকর অ্যাম্বুলেন্স

চোখ বন্ধ করলেই আব্দুল করিমের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঢাকার পুরনো অলিগলির ছবি। সেখানকার ধুলোমাখা, গাড়ির হর্নের তীব্র আওয়াজ, ভিখারির কাতর ডাক – কোলাহলের এই নগরীতে ঘাপটি মেরে থাকা রহস্যেরা যেন ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে।

রিক্সার ঘণ্টার মতো বারবার কানে বাজে আব্দুর রহমান চাচার সতর্কবাণী,

"ভূতে বিশ্বাস করিস না করিম, এইসব বাজে কথা।"

কিন্তু রহমান চাচাকে তো একরাতেই গ্রাস করে নিলো অদৃশ্য কোন শক্তি, শুধু তার লাশটা পড়ে রইল খালি অ্যাম্বুলেন্সে। সেই রাতের পর থেকে করিম জানে, ভূত আছে, অদৃশ্য ক্ষমতার অস্তিত্ব আছে, আর তাদের নিয়ে যে রহস্য তৈরি হয়, সেই রহস্য কখনোই সমাধান হয় না, শুধু মানুষকে পাগল করে তোলে!

অ্যাম্বুলেন্সের রহস্য

অ্যাম্বুলেন্সটার ভেতরের বাতাস ঘন হয়ে উঠেছে। এখানে শুধু মৃত্যুর গন্ধ নয়, আরও কিছু আছে। স্যাঁতসেঁতে, গোলমেলে… একটা ভয়ংকর উপস্থিতি যেন ঘিরে ধরেছে। করিমের গা শিরশির করে ওঠে। তার মনে হয় এই অ্যাম্বুলেন্সটা শুধু একটা লাশ নিয়ে যাচ্ছে না, আরও অশরীরী এক যাত্রী এখানে লুকিয়ে আছে।

"রহমান চাচা…" গলাটা কাঁপছে করিমের, "আমার কেমন যেন ভয় করছে।"

রহমান চুপ করে আছেন। একরাশ চুল পড়েছে কপালে, চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে বোধহয় অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে। করিম আবার ডাক দিল,

"রহমান চাচা?"

কোনো সাড়া শব্দ নেই। করিম আর্তনাদ করে উঠল,

"চাচা! কি হলো আপনার?"

অ্যাম্বুলেন্স যেন নিজের থেকেই গতি কমিয়ে এনে থামলো। রহমান স্টিয়ারিং এর উপর লুটিয়ে পড়েছেন। করিম তাকে ধাক্কা দিলো। ঠান্ডা, বরফের মতো ঠান্ডা রহমানের শরীর। চোখ বড় বড় করে খোলা, যেন অদৃশ্য কিছু দেখে চরম আতঙ্কে তার প্রাণ বেরিয়ে গেছে।

করিমের চোখে অন্ধকার নেমে এলো। সে নিজেও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। অজ্ঞান হওয়ার আগের সেকেন্ডে তার মনে হলো অ্যাম্বুলেন্সের সিলিং থেকে একটা অস্পষ্ট ছায়া নেমে আসছে, সাদা কাপড়ে মোড়া। ওই ছায়ার দিক থেকেই ভেসে আসছে মৃত্যু আর একটা অচেনা ভয়ের বাসি গন্ধ।

চোখ খুলে করিম দেখলো, সে নিজের বাড়ির বিছানায়। পাশে বসে আছেন মর্গের ডাক্তার।

"হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন?" ডাক্তার মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

করিমের সব ঘটনা মনে পড়লো। কিন্তু কিছুতেই সে মুখ খুলতে পারছে না। কেউ কি বিশ্বাস করবে? ডাক্তার তাকে কি পাগল ভাববেন?

"রহমানকে স্ট্রোক করেছিল। হয়তো সে কারণেই অ্যাম্বুলেন্স থামিয়েছিল",

ডাক্তার তার নিজের মনেই আন্দাজ করলেন,

"এইসব পুরনো গাড়ী, কখন কি হবে বলা যায় না। তুই ভাগ্যিস, অ্যাম্বুলেন্স নিজে থেকেই রাস্তার পাশে থেমেছিল। না হলে তোরও বিপদ হতে পারতো। যাই হোক, এখন বিশ্রাম কর।"

করিম চুপ করে রইলো। তার কি বিশ্রাম হবে? রহমানের জায়গায় সে থাকলেও কি রহমানের মতোই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তো?

সেইদিনের পর থেকে করিম মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। তার মনে হয়, ওই রাতে তাকে যা ভয় পাইয়েছিল তা কোনো সাধারণ ভূত ছিল না। ওটা যে কিছুই করুক না কেন, ওটা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। সেটা হয়তো এখনো ওই অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে আছে, একটা নতুন শিকারের অপেক্ষায়।

রাতের পর রাত করিমের ঠিকমতো ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে – রহমানের মৃত মুখ, সাদা কাপড়ের ছায়া আর সেই অদৃশ্য লাশটার যেন একটি বিষাক্ত নিঃশ্বাস গ্রাস করছে তাকে। কেউ যখন করিমের এরকম পাগলাটে কথা শুনতে রাজি হয় না, তখন সে পাগলের মতো রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সে সেই ভুতুড়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খুঁজে বের করতে চায়।

একদিন গভীর রাতে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর করিমের সামনে এসে পড়ে সেই অ্যাম্বুলেন্সটা। রাস্তার কোণে একটা পুরনো গ্যারাজের সামনে দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে দেখতে পেলো অ্যাম্বুলেন্সটার ভেতর কেউ নেই, সম্পূর্ণ ফাঁকা। কিন্তু ভেতর ঢুকতেই একটা বাসি, মৃত্যুর মতো গন্ধ এসে নাকে লাগে। করিমের মনে হয়, এইখানেই সেই অদ্ভুত উপস্থিতি এখনো লুকিয়ে আছে।

হঠাৎ অ্যাম্বুলেন্সটার দরজা দ্রুতবেগে বন্ধ হয়ে গেল! করিমকে বন্দী করে রাখা হলো ভেতরে। তার বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি শুরু হলো। অ্যাম্বুলেন্সটা এবার নিজে থেকেই চলতে শুরু করল, যেন গন্তব্য ঠিক করে নিয়েছে…কিন্তু কোথায়?

গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছে করিমকে কোথায়? এ কি আবারও হবে রহমান চাচার মতো নৃশংস শেষ? করিম আতঙ্কে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। ঠিক তখনই থেমে যায় অ্যাম্বুলেন্সটা। সামনে সেই চেনা মর্গের দরজা।

করিম হতভম্ব। ওই অদৃশ্য উপস্থিতি তাকে মর্গেই নিয়ে এসেছে কেন? কী করতে চায় সে? দরজা খুলে গেলো আর একটা সাদা মোড়ানো, লম্বা চেহারার কিছু একটা অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হলো। সেই ছায়াটা কি তার দিকেই আসছে? এটাই কি সেই লাশ, যেটা আগের রাতে হয়ে গিয়েছিল অদৃশ্য? করিম ভয়ে বসে পড়ল। এটাই কি তার শেষ?

কিন্তু তার আশ্চর্যের সীমা রইলো না! ওই অস্পষ্ট ছায়াটা তার সামনে এসে আস্তে আস্তে সাদা কাপড় মোচড়াতে লাগলো। করিম দেখতে পেলো, কাপড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট বিড়ালছানা, রোগা পাতলা, সারা শরীরে ক্ষত। অসহায়ভাবে সেটা ডাকতে শুরু করল।

করিম ভালো করে বুঝতে পারলো। ওই বিড়ালছানাটাই হয়তো গত রাতে অ্যাম্বুলেন্সে আটকে পড়েছিল। ভয়ে রহমান চাচার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, আর বিড়ালটাকেই হারিয়ে যাওয়া লাশ ভেবেছিল সে। আর আজকে বিড়ালছানাটা করিমকে মর্গে নিয়ে এলো, যেন সেই উদ্ধার করুক তাকে।

করিম বিড়ালছানাটিকে কোলে তুলে নিল। ওটা তার হাত চাটতে শুরু করল। করিমের চোখ ভিজে গেল। গত কয়েকদিনের দুঃস্বপ্ন, অস্থিরতা যেন মিলিয়ে গেল। আজ এই অসহায় বিড়ালটাকে বাঁচানোটাই যেন তার মনের ভয়কে সরিয়ে দিতে পারবে, এই ছোট্ট প্রাণটাই যেন তার রহস্যের ভয়কে দূর করে দেবে।

বিড়ালছানার রহস্য

করিম বিড়ালছানাটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। ওর নাম রাখলো 'রহস্য', কারণ রহস্যের কারণেই তো সে এই ছোট্ট প্রাণীটিকে পেয়েছে। রহস্য দিন দিন সুস্থ হয়ে উঠছে, করিমের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

কিন্তু করিমের মনের শান্তি টিকল না বেশিদিন। রহস্যের আসার পর থেকেই তার ঘরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু হলো। রাতের বেলায় কে যেন ঘরের জিনিসপত্র নড়াচড়া করছে, আলো নিভে যাচ্ছে, আবার স্যুইচ চালু করলেই দেখা যাচ্ছে আলো জ্বলছে।

এক রাতে করিমের ঘুম ভাঙলো একটা অদ্ভুত শব্দে। ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলো, রহস্য বিছানার পাশে বসে আছে, তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারে। হঠাৎ রহস্য 'মিউ' করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটা অস্পষ্ট ছায়া।

করিম ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। ছায়াটা দ্রুতবেগে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। করিম চোখ বন্ধ করে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

রহস্যের পিছনে রহস্য

চোখ খুলতেই করিম দেখতে পেলো, সে হাসপাতালের বিছানায়। পাশে বসে আছে তার বন্ধু রিপন। রিপন জানালো, রাস্তার পাশে অজ্ঞান অবস্থায় করিমকে পেয়েছে।

করিম রিপনকে সব ঘটনা খুলে বললো। রিপন প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু করিমের কথা শুনে তার মনেও সন্দেহ জাগলো। রিপন করিমকে নিয়ে গেল মর্গে।

মর্গের কর্মীরা জানালো, রহস্যময়ভাবে আবারও অ্যাম্বুলেন্সটি গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গেছে। রিপন ও করিম দ্রুত গ্যারেজে ছুটে গেল।

গ্যারেজে পৌঁছে করিম ও রিপন অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে কেউ নেই, তবে সামনের সিটে রাখা ছিলো একটা পুরোনো ডায়েরি।

ডায়েরিটা খুলে দেখতে পেলো করিম, এটা ছিলো রহমান চাচার। ডায়েরিতে রহমান চাচা লিখেছিলেন অ্যাম্বুলেন্সে ঘটে যাওয়া রহস্যময় ঘটনাগুলোর কথা।

রহমান চাচা লিখেছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সে একটা অশরীরী উপস্থিতি আছে, যা লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। রহমান চাচা ওই উপস্থিতিটাকে দেখেছিলেন, ভয়ে তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।

ডায়েরিটা পড়ে করিম বুঝতে পারলো, ওই অ্যাম্বুলেন্সটাই হলো রহস্যের সমাধানের চাবিকাঠি। অশরীরী উপস্থিতি কেন ওই অ্যাম্বুলেন্সেই আটকে আছে, কী তার উদ্দেশ্য – সেসবের উত্তর খুঁজতে হলে তাকে নিজেকে বিপদে ফেলতে হবে।

করিম ও রিপন ঠিক করলো আজ রাতে তারাই অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে বেরোবে। যখনই ওই উপস্থিতি আসবে, তখনই তারা মুখোমুখি হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেবে।

রাতে করিম ও রিপন অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে বের হলো। চালু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা যেন নিজের থেকেই চলতে লাগলো। তারা বুঝতে পারলো, তাদের হাতে আর গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেই। এবার অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে।

হঠাৎ করেই গাড়িটা থেমে গেল। তারা পৌঁছে গেছে মর্গের সামনে। কিন্তু এটা এতো রাতে কেন নিয়ে এলো ওই অদৃশ্য চালক? দরজা খুলে গেলো যেন আপনাআপনি। করিম ও রিপন এবার ভয় পেলেও পিছিয়ে আসতে পারলো না। তারা নামলো গাড়ি থেকে। ওই অদৃশ্য উপস্থিতি যেন তাদেরকে মর্গের ভেতরে ডাকছে।

করিম ও রিপন আস্তে আস্তে মর্গের দিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারলো কিছু একটা ভুল আছেে। কোথাাও কোনো লাশ নেই। সব স্ট্রেচার ফাঁাকা।

করিম ও রিপন ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতে যাবেে, এমন সময় দেখলো সামনের দেওয়ালে একটা আলোর রেখা ফুটে উঠছে। আলোর রেখাটা যেন একটা দরজার আকার নিলো।

তাদের জানা ছিল নাো এই দরজার ওপাশেে কী অপেক্ষা করছে, তবুও ওই অদৃশ্য শক্তির টানেতারা দরজাটার কাছছ এগিয়ে গেল। তারপর একসাথে দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো।

রহস্যের সমাধান?

দরজাটা পাশ কাটিাতেই করিম ও রিপন চমকে উঠলো। এ তো একদম আলাদা জগৎ! সমুদ্রের ধাড়, গুহা, পাহাড়… এসব কোথা থেকে এলো মর্গের ভেতর? সামনে রাখা আছ়ে একটা ছোট্ট বালক, সে তাদের দেখে হাসছয়।

করিম জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কে?"

বালকটা জবাব দিলো, "আমি রহস্য।"

করিম আর রিপন অবাক। ওই অ্যাম্বুলেন্স চালায় কী? লাশগুলো নিয়ে যায় কী? এরকম অদ্ভুত জগতে ওদেরকে নিয়ে এলো কেন?

বালকটা বুঝতেে পারলো তাদের অসংখ্য প্রশ্ন,

"ভয় পেয়ো না, আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আসলে এই যে অ্যাম্বুলেন্স দেখছো, এটা কোন সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স নয়। এই অ্যাম্বুলেন্স মৃত্যুর জগৎ আর স্বপ্নের জগতের মাঝে সেতু বন্ধন করে। তোমরা যে অদ্ভুত ঘটনা দেখলে, সেটা আমার হাতের কাজ। আসলে আমি যেসব আত্মাদের, শরীর থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করি, তাদের স্বপ্নের জগত নিয়ে যাই।"

করিম সব শুনে অবাক! তাহলে ওর রহমান চাচাকেও মুক্ত করা হয়়েছিল এইভাবে? করিম আস্তে আস্তে বলল,

"কী করতে হবে রহমান চাচাকে দেখতে পেতে?"

রহস্যময় বালকটা মুচকি হেসল। একটা আলোর রেখা দেখালো।

"ওই পথ দিয়ে গেলেই তুমি তোমার চাচাকে পােবা।"

করিম দেরী না করে সেই পথেই ছুটলো। রিপনও তাড়াতাড়ি তার পিছন পিছন গেল। এখানকার সময়ের নিয়ম কী, সেটা কারোরই জানা নেই। তারা যখন ফিরে আসবে, তখন পৃথিবীর কতটা সময় কেটে গেছে কী জানে!

Read more